রুকইয়াহ শারইয়াহ পরিচিতিঃ

উম্মু সালামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে একটি মেয়েকে দেখলেন, যার চেহারা মলিন। তিনি (সাঃ) বললেনঃ তার জন্য রুকইয়ার ব্যবস্থা কর। কেননা তার উপর নযর লেগেছে।
[মুসলিম ৩৯/২১, হাঃ ২১৯৭] (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩১৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২১৫)

রুকইয়ার খোলাসা অর্থঃ

❝ সকল প্রকার শারীরিক-মানসিক রোগ এবং জীন-যাদু, বদনজর, হাসাদ ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট সমস্যা বা অসুস্থতা থেকে সুস্থতা লাভের জন্য কুরআনের আয়াত, হাদিসে বর্ণিত দুআ এবং হারাম, না-জায়েজ ও কুফর-শিরকমুক্ত শরয়ী বৈধ বাক্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুর উপর পাঠ করার মাধ্যমে চিকিৎসা করাকেই রুকইয়াহ শারইয়াহ বলে। ❞

রুকইয়ার বিস্তারিত বিবরণ:

কুরআন থেকে রুকইয়ার পরিচয়।

রাক্বী এবং রুকইয়াহ রিলেটেড একটি আয়াত কুরআনে সূরা কিয়ামার ২৭ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
کَلَّاۤ اِذَا بَلَغَتِ التَّرَاقِیَ ۙ
কখনও না, যখন প্রাণ কন্ঠাগত হবে।
وَقِیۡلَ مَنۡ ٜ  رَاقٍ ۙ
এবং বলা হবে, কে রুকইয়াহ করবে?

এবার আসুন কুরআনে বর্ণিত এই রুকইয়াহ শব্দটির সাথে পরিচিত হই।

রুকইয়ার শাব্দিক অর্থ—
ইবনু সাইদাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন,
الرقية هي العوذة
(المحكم والمحيط الأعظام ٢/٣٠٩)
রুকইয়াহ মানে হলো “আশ্রয় গ্রহণ করা/ আশ্রয় প্রার্থনা করা।
আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ বলেন,
الرقية: هي القراءة أو القول
রুকইয়াহ মানে হলো, পাঠ করা অথবা বলা।

রুকইয়ার আরেকটি শাব্দিক অর্থ হলো, التعويذ তবে এই التعويذ শব্দের অর্থ কি?
التعويذ: هو الالتجاء الى الشيء، فيقال أعوذ بالله أي ألتجأ اليه. (الأحكام الفقهية في الرقية الشرعية – ص-٢٢)
তা’বিজ (التعويذ) মানে হলো কোন কিছুর আশ্রয় নেওয়া। যেমন বলা হয়, আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি অর্থাৎ আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় নিচ্ছি।

মোটকথা: রুকইয়ার শাব্দিক অর্থ হলো, আশ্রয় গ্রহণ করা, আশ্রয় চাওয়া, আশ্রয় নেওয়া এবং আশ্রয় প্রার্থনা করা। দ্বিতীয় অর্থ হলো বলা অথবা পাঠ করা । আর এটাই শাব্দিক অর্থ হিসেবে সব থেকে বিশুদ্ধ। কেননা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত।
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ فِي الرُّقْيَةِ تُرْبَةُ أَرْضِنَا وَرِيقَةُ بَعْضِنَا يُشْفٰى سَقِيمُنَا بِإِذْنِ رَبِّنَا.
তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকইয়াতে বলতেন আমাদের দেশের মাটি এবং আমাদের কারও থুথুতে আমাদের প্রতিপালকের নির্দেশে আমাদের রোগী আরোগ্য লাভ করে। (সহীহ বুখারী- ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২২২)

এই হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রুকইয়াহ সম্পন্ন করা হয় মূলত কোন কিছু বলা, পাঠ করা বা পড়ার মাধ্যমেই।

আবু সাইদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আরেক হাদিসে এসেছে,
وَاللَّهِ إِنِّي لَرَاقٍ/ لأرقي وَلَكِنْ وَاللَّهِ لَقَدِ اسْتَضَفْنَاكُمْ فَلَمْ تُضَيِّفُونَا، فَمَا أَنَا بِرَاقٍ لَكُمْ حَتَّى تَجْعَلُوا لَنَا جُعْلاً‏.‏ فَصَالَحُوهُمْ عَلَى قَطِيعٍ مِنَ الْغَنَمِ، فَانْطَلَقَ فَجَعَلَ يَتْفُلُ وَيَقْرَأُ ‏(‏الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ‏)‏ حَتَّى لَكَأَنَّمَا نُشِطَ مِنْ عِقَالٍ،
আল্লাহর কসম আমি একজন রাক্বী/আমি রুকইয়াহ করি। তবে আল্লাহর কসম! আমরা তোমাদের নিকট মেহমান হতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমরা আমাদের মেহমানদারী করনি। তাই আমি ততক্ষন পর্যন্ত তোমাদের রাক্বী নই যতক্ষন না তোমরা আমাদের জন্য মজুরী নির্ধারণ করবে।
তখন তারা তাদের একপাল বকরী দিতে সম্মত হল। তারপর সে সাহাবী সেখানে গেলেন এবং আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন (সূরা ফাতিহা) পাঠ করে ( يَقْرَأُ)
থুথু নিক্ষেপ করতে থাকলেন। অবশেষে সে ব্যাক্তি এমনভাবে সুস্থ হল যেন বন্ধন থেকে মুক্তি পেল।

فَقَدِمُوا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرُوا لَهُ فَقَالَ ‏”‏ وَمَا يُدْرِيكَ أَنَّهَا رُقْيَةٌ”
এই ঘটনার পরে সাহাবীরা রাসূল ﷺ এর মতামত জানার জন্য যখন আসেন তখন রাসূল ﷺ আবু সাইদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন তুমি কিভাবে জানলে যে, সূরা ফাতিহা হলো রুকইয়াহ?
(সহীহ বুখারী- ৫৭৪৯)

মানে উক্ত সাহাবি সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন আর রাসূল ﷺ সূরা ফাতিহাকেই রুকইয়াহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর আবু সাইদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু রুকইয়াহ তথা সূরা ফাতিহাকে পাঠ করার মাধ্যমেই তার রুকইয়াহ সম্পন্ন করেছে। সুতরাং উপরিউক্ত দুটো হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শাব্দিক অর্থে “কোনকিছু বলা বা পাঠ করাকেই” মূলত রুকইয়াহ বলে।

রুকইয়ার শরয়ী বা পারিভাষিক অর্থ—

শামসুল হক আজিম আবাদি বলেন,
قال شمس الحق العظيم أبادي: الرقية : هي العوذة اي ما يرقى به من الدعاء لطلب الشفاء.
(عون المعبود شرح سنن أبي داوود – ١٠/ ٣٧٠)
রুকইয়াহ মানে হলো “আশ্রয় গ্রহণ করা/ আশ্রয় প্রার্থনা করা। অর্থাৎ সুস্থতা লাভের জন্য যে দুআ পাঠ করা হয় তাকেই রুকইয়াহ বলে।

ইবনুল আসির রহিমাহুল্লাহ বলেন,
الرقية : العوذة التي يرقي بها صاحب الآفاة، كالحمى والصرع، وغير ذالك من الآفات. ( النهاية في الغريب الحديث ٢/ ٢٥٤)
এমন আশ্রয় প্রার্থনা মূলক বাক্য যা দ্বারা জ্বর, জ্বীনে ধরা রোগ এবং এজাতীয় অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে রুকইয়াহ করা হয়।

الرقية: العوذة يتلفظ بها للمريض فإذا كتبت وعلقت عليه فهي تميمة.
রুকইয়াহ মানে হলো, এমন আশ্রয় প্রার্থনা মূলক বাক্য যা অসুস্থ ব্যক্তির (সুস্থতার) জন্য মুখে উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু এই বাক্যগুলোকেই আবার যখন লিখে ব্যক্তির শরীরে লটকানো হয় তখন তাকে তামিমাহ বলা হয়। এই সংজ্ঞা معجم المعاني الجامع তে উল্লেখ করা হয়েছে।

আওনুল মা’বুদ শরহে ইবনে আবি দাউদে বর্ণিত হয়েছে,
الرقى: ما يقرأ من الدعاء لطلب الشفاء. (عون المعبود سرح ابن أبي داود – ١٠/ ٦٤)
সুস্থতা তলব করার জন্য যা পাঠ করা হয় তাকেই রুকইয়াহ বলে।

ইবনে হাজার আসকালানি রহিমাহুল্লাহ বলেন,
الرقية كلام يستشفى به من كل عارض.
( فتح الباري لابن حجر – ٤/ ٥٣٠)
রুকইয়াহ হলো এমন কালাম যার মাধ্যমে প্রত্যেক আপতিত রোগ থেকে আরোগ্য কামনা করা হয়।

ইমাম হাফেজ আয-যাহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
الرقى والعُوَذ هي التجاء إلى الله سبحانه وتعالى ليهب الشفاء كما يعطيه بالدواء. ( الطب النبوي للذهبي – ٦٨٥)
রুকইয়াহ মানে হলো- আল্লাহ তায়ালার নিকট আশ্রয় নেওয়া যাতে করে তিনি শিফা দান করেন যেমনি ভাবে ওষুধ-পত্রের মাধ্যমে তিনি শিফা দান করে থাকেন।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন;
الرقى بمعنى التعويذ، والاسترقاء طلب الرقية، و هو من أنواع الدعاء. ( مجموع الفتاوى ١/ ١٨٢، ٣٢٨ — ١٠/ ١٩٠)
রুকইয়াহ মানে হলো আশ্রয়ে দেওয়া, আর ইস্তিরক্বার অর্থ হলো অন্যের নিকট রুকইয়াহ চাওয়া বা তলব করা। আর রুকইয়াহ মূলত দুআরই একটি প্রকার।

মোটকথা: পারিভাষিক অর্থে রুকইয়াহ মানে হলো,
❝ সকল প্রকার শারীরিক-মানসিক রোগ এবং জীন-যাদু, বদনজর, হাসাদ ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট সমস্যা বা অসুস্থতা থেকে সুস্থতা লাভের জন্য কুরআনের আয়াত, হাদিসে বর্ণিত দুআ এবং হারাম, না-জায়েজ ও কুফর-শিরকমুক্ত শরয়ী বৈধ বাক্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুর উপর পাঠ করার মাধ্যমে চিকিৎসা করাকেই রুকইয়াহ শারইয়াহ বলে। ❞

প্রচলিত অর্থে রুকাইয়ার মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে! রুকইয়াহ চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমরা শুধু রুকইয়ার উপর সীমাবদ্ধ থাকি না বরং তীব্বে নবাবীর অনেক বিষয় এখানে সমন্বয় ঘটে। আর এই পুরো সিস্টেমটাই রুকইয়াহ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
সুতরাং আমরা বলতে পারি, জিন, জাদু বদনজর এবং এগুলোর কারণে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তীব্বে নববীর যে সব পদ্ধতি এবং অভিজ্ঞতার আলোকে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় প্রচলিত অর্থে তাকেই রুকইয়াহ শারইয়া বলা হয়।

শরয়ী রুকইয়ার হুকুম কি?

শরয়ী রুকইয়ার হুকুম হলো সুন্নাহ। যেমন, ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
يقول الإمام النووي رحمه الله: وأما الرقى بآيات القرآن وبالأذكار المعروفة فلا نهى فيه بل هي سنة. ( معارج القبول: ٢/ ١٥٩)
যদি কুরআনের আয়াত এবং অর্থ বোধগম্য হয় এমন জিকির দ্বারা রুকইয়াহ করা হয় তাহলে এমন রুকইয়াহ নিষিদ্ধ নয় বরং তা সুন্নাহ।

শরয়ী রুকইয়ার হুকুম হলো সুন্নাহ। শুধু সুন্নাহই নয় বরং এটি মানব জীবনে বিশেষ করে মুসলিমদের জীবনে পালনীয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাহ। ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ এর উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে আমি কিছু দলিল উল্লেখ করছি ইনশাআল্লাহ।
এবিষয়ে দলিল উল্লেখ করার আগে আমরা আসুন দেখে নেই সুন্নাহের সংজ্ঞা কি?
আল্লামা শাওকানী রহিমাহুল্লাহ সুন্নাহের সংজ্ঞায় বলেন:
وأما معناها شرعًا: أي: في اصطلاح أهل الشرع فهي: قول النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وفعله، وتقريره — أنظر — ارشاد الفحول الى تحقيق الحق من علم الاصول ، الفصل الاول، في معنى السنة لغة وشرعا 1 – 95
‘‘শরয়ী পরিভাষায় সুন্নাহেরর অর্থ: তথা শরীয়তবিদদের পরিভাষায় সুন্নাহ হচ্ছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কাজ ও সমর্থন।
শরয়ী রুকইয়ার ক্ষেত্রে রাসূল ﷺ এর কথা, কাজ ও সমর্থন সম্বলিত হাদিসগুলো আমি একেক করে উল্লেখ করছি ইনশাআল্লাহ।

শরয়ী রুকইয়াহ সম্পর্কে রাসূল ﷺ এর কওলী হাদিস।

১/ আওফ ইবনু মালিক আশজা’ঈ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত,
عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ الأَشْجَعِيِّ، قَالَ كُنَّا نَرْقِي فِي الْجَاهِلِيَّةِ فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ تَرَى فِي ذَلِكَ فَقَالَ ‏ “‏ اعْرِضُوا عَلَىَّ رُقَاكُمْ لاَ بَأْسَ بِالرُّقَى مَا لَمْ يَكُنْ فِيهِ شِرْكٌ ‏”‏ ‏.‏
তিনি বলেন, আমরা জাহিলী (মূর্খতার) যুগে রুকইয়াহ করতাম। এজন্যে আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আবেদন করলাম- হে আল্লাহর রসূল! এক্ষেত্রে আপনার মতামত কি? তিনি বললেন, তোমাদের রুকইয়াহগুলো আমার নিকট উপস্থাপন করো, রুকইয়াহ তে কোন সমস্যা নেই- যদি তাতে কোন শিরক (জাতীয় কথা) না থাকে।
(সহীহ মুসলিম-ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৫৪৪)

হাদিসটির দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে, রুকইয়াহ সম্পর্কে রাসূল ﷺ এর মতামত জানতে চাওয়া হলে, তিনি তার কওল বা বক্তব্যের মাধ্যমে শিরক মুক্ত রুকইয়াহ তথা শরয়ী রুকইয়ার অনুমোদন দিয়েছেন। শুধু তাই নয় তিনি তার لاَ بَأْسَ بِالرُّقَى مَا لَمْ يَكُنْ فِيهِ شِرْكٌ এই কওলের মাধ্যমে শরয়ী রুকইয়ার মধ্যে ইজতেহাদ করার দরজাও খুলে দিলেন।

২/ জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
عَنْ جَابِرٍ، قَالَ نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الرُّقَى فَجَاءَ آلُ عَمْرِو بْنِ حَزْمٍ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّهُ كَانَتْ عِنْدَنَا رُقْيَةٌ نَرْقِي بِهَا مِنَ الْعَقْرَبِ وَإِنَّكَ نَهَيْتَ عَنِ الرُّقَى ‏.‏ قَالَ فَعَرَضُوهَا عَلَيْهِ ‏.‏ فَقَالَ ‏ “‏ مَا أَرَى بَأْسًا مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ يَنْفَعَ أَخَاهُ فَلْيَنْفَعْهُ ‏”‏ ‏.‏
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এক সময়) রুকইয়াহ নিষেধ করে দিলেন। তখন আমর ইবনু হাযম গোষ্ঠীর লোকেরা এসে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের কাছে একটি রুকইয়াহ ছিল, যা দিয়ে আমরা বিচ্ছুর কামড়ে রুকইয়াহ করতাম। আর আপনি তো রুকইয়াহ নিষেধ করে দিয়েছেন। রাবী জাবির (রাঃ) বলেন, তারা তা তাঁর কাছে পেশ করল। তখন তিনি বললেন, কোন অসুবিধা দেখতে পাচ্ছি না। তোমাদের যে কেউ তার ভাইয়ের কোনও উপকার করতে সমর্থ হলে সে যেন তার উপকার করে।
(সহীহ মুসলিম- ইসলামিক ফাউন্ডেশন— ৫৫৪৩)

উক্ত হাদিসে রাসূল ﷺ তার কওল বা বক্তব্যের মাধ্যমে শরয়ী রুকইয়ার অনুমতি দিলেন এবং সাথে সাথে এটাও বললেন যে, তোমাদের কেউ যদি তার ভাইয়ের শরয়ী রুকইয়ার মাধ্যমে কোনও উপকার করতে সমর্থ হয় তাহলে সে যেন তার উপকার করে।

শরয়ী রুকইয়াহ সম্পর্কে রাসূল ﷺ এর ফে’লী হাদিস।

১/ ’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে,
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَنْفُثُ عَلَى نَفْسِهِ فِي الْمَرَضِ الَّذِي مَاتَ فِيهِ بِالْمُعَوِّذَاتِ، فَلَمَّا ثَقُلَ كُنْتُ أَنْفِثُ عَلَيْهِ بِهِنَّ، وَأَمْسَحُ بِيَدِ نَفْسِهِ لِبَرَكَتِهَا‏.‏ فَسَأَلْتُ الزُّهْرِيَّ كَيْفَ يَنْفِثُ قَالَ كَانَ يَنْفِثُ عَلَى يَدَيْهِ، ثُمَّ يَمْسَحُ بِهِمَا وَجْهَهُ‏.‏
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে রোগে ওফাত পান সেই রোগের সময়ে তিনি নিজ দেহে ’মু’আব্বিযাত’ পড়ে ফুঁক দিতেন। অতঃপর যখন রোগের তীব্রতা বেড়ে গেল, তখন আমি সেগুলো পড়ে ফুঁক দিতাম। আর আমি তাঁর নিজের হাত তাঁর দেহের উপর বুলিয়ে দিতাম। কেননা, তাঁর হাতে বারাকাত ছিল। রাবী বলেনঃ আমি যুহরীকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কীভাবে ফুঁক দিতেন? তিনি বললেনঃ তিনি তাঁর দু’ হাতের উপর ফুঁক দিতেন, অতঃপর সেই দু’ হাত দিয়ে আপন মুখমন্ডল বুলিয়ে নিতেন।
(সহীহ বুখারী- ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২১১)

২/ ’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত,
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يُعَوِّذُ بَعْضَ أَهْلِهِ، يَمْسَحُ بِيَدِهِ الْيُمْنَى وَيَقُولُ ‏ “‏ اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ أَذْهِبِ الْبَاسَ، اشْفِهِ وَأَنْتَ الشَّافِي، لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا ‏”‏‏.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোন কোন স্ত্রীকে সূরা নাস ও সূরা ফালাক পড়ে ডান হাত দিয়ে বুলিয়ে দিতেন এবং পড়তেনঃ হে আল্লাহ! মানুষের প্রতিপালক, কষ্ট দূর কর এবং আরোগ্য দান কর, তুমিই আরোগ্য দানকারী, তোমার আরোগ্য ছাড়া অন্য কোন আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য দাও, যা কোন রোগ অবশিষ্ট থাকে না।
(সহীহ বুখারী- আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩২৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২১৯)

৩/ ’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَرْقِي يَقُوْلُ امْسَحْ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ بِيَدِكَ الشِّفَاءُ لاَ كَاشِفَ لَه“إِلاَّ أَنْتَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঝাড়-ফুঁক করতেন। আর এ দু’আ পাঠ করতেনঃ ব্যথা দূর করে দাও, হে মানুষের পালনকর্তা। আরোগ্যদানের ক্ষমতা কেবল তোমারই হাতে। এ ব্যথা তুমি ছাড়া আর কেউ দূর করতে পারে না।
(সহীহ বুখারী- আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩২৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২২০)

৪/ ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ একটি অধ্যায় এভাবে কায়েম করেছেন,
بَاب رُقْيَةِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم
عَنْ عَبْدِ الْعَزِيزِ قَالَ دَخَلْتُ أَنَا وَثَابِتٌ عَلٰى أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ فَقَالَ ثَابِتٌ يَا أَبَا حَمْزَةَ اشْتَكَيْتُ فَقَالَ أَنَسٌ أَلاَ أَرْقِيكَ بِرُقْيَةِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ بَلٰى قَالَ اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ مُذْهِبَ الْبَاسِ اشْفِ أَنْتَ الشَّافِي لاَ شَافِيَ إِلاَّ أَنْتَ شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا.

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক রুকইয়াহ।

আবদুল ’আযীয (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ও সাবিত একবার আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর নিকট গেলাম। সাবিত বললেন, হে আবূ হামযা! আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। তখন আনাস (রাঃ) বললেনঃ আমি কি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দিয়ে রুকইয়াহ করেছিলেন তা দিয়ে রুকইয়াহ করে দেব? তিনি বললেনঃ হাঁ। তখন আনাস (রাঃ) পড়লেন- হে আল্লাহ! তুমি মানুষের রব, রোগ নিরাময়কারী, আরোগ্য দান কর, তুমি আরোগ্য দানকারী। তুমি ব্যতীত আর কেউ আরোগ্য দানকারী নেই। এমন আরোগ্য দাও, যা কোন রোগ অবশিষ্ট রাখে না।
(সহীহ বুখারী- ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২১৮)

তাহলে উপরের সকল ফে’লী হাদিসগুলো থেকে এবং ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ এর বাবের শিরোনাম কায়েম করা থেকেও এটা প্রমাণিত হলো যে, রাসূল ﷺ নিজেই রুকইয়াহ করতেন।

শরয়ী রুকইয়াহ সম্পর্কে রাসূল ﷺ এর তাক্বরীরি হাদিস।

১/ আবূ সাঈদ (রাযি.) হতে বর্ণিত,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ انْطَلَقَ نَفَرٌ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي سَفْرَةٍ سَافَرُوهَا حَتَّى نَزَلُوا عَلَى حَيٍّ مِنْ أَحْيَاءِ الْعَرَبِ فَاسْتَضَافُوهُمْ فَأَبَوْا أَنْ يُضَيِّفُوهُمْ فَلُدِغَ سَيِّدُ ذَلِكَ الْحَيِّ فَسَعَوْا لَهُ بِكُلِّ شَيْءٍ لاَ يَنْفَعُهُ شَيْءٌ فَقَالَ بَعْضُهُمْ لَوْ أَتَيْتُمْ هَؤُلاَءِ الرَّهْطَ الَّذِينَ نَزَلُوا لَعَلَّهُ أَنْ يَكُونَ عِنْدَ بَعْضِهِمْ شَيْءٌ فَأَتَوْهُمْ فَقَالُوا يَا أَيُّهَا الرَّهْطُ إِنَّ سَيِّدَنَا لُدِغَ وَسَعَيْنَا لَهُ بِكُلِّ شَيْءٍ لاَ يَنْفَعُهُ فَهَلْ عِنْدَ أَحَدٍ مِنْكُمْ مِنْ شَيْءٍ فَقَالَ بَعْضُهُمْ نَعَمْ وَاللهِ إِنِّي لأرْقِي وَلَكِنْ وَاللهِ لَقَدْ اسْتَضَفْنَاكُمْ فَلَمْ تُضَيِّفُونَا فَمَا أَنَا بِرَاقٍ لَكُمْ حَتَّى تَجْعَلُوا لَنَا جُعْلاً فَصَالَحُوهُمْ عَلَى قَطِيعٍ مِنْ الْغَنَمِ فَانْطَلَقَ يَتْفِلُ عَلَيْهِ وَيَقْرَأُ الْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ فَكَأَنَّمَا نُشِطَ مِنْ عِقَالٍ فَانْطَلَقَ يَمْشِي وَمَا بِهِ قَلَبَةٌ قَالَ فَأَوْفَوْهُمْ جُعْلَهُمْ الَّذِي صَالَحُوهُمْ عَلَيْهِ فَقَالَ بَعْضُهُمْ اقْسِمُوا فَقَالَ الَّذِي رَقَى لاَ تَفْعَلُوا حَتَّى نَأْتِيَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَنَذْكُرَ لَهُ الَّذِي كَانَ فَنَنْظُرَ مَا يَأْمُرُنَا فَقَدِمُوا عَلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرُوا لَهُ فَقَالَ وَمَا يُدْرِيكَ أَنَّهَا رُقْيَةٌ ثُمَّ قَالَ قَدْ أَصَبْتُمْ اقْسِمُوا وَاضْرِبُوا لِي مَعَكُمْ سَهْمًا فَضَحِكَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم.
তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর একদল সাহাবী কোন এক সফরে যাত্রা করেন। তারা এক আরব গোত্রে পৌঁছে তাদের মেহমান হতে চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। সে গোত্রের সরদার বিচ্ছু দ্বারা দংশিত হল। লোকেরা তার (আরোগ্যের) জন্য সব ধরনের চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই কোন উপকার হল না। তখন তাদের কেউ বলল, এ কাফেলা যারা এখানে অবতরণ করেছে তাদের কাছে তোমরা গেলে ভাল হত। সম্ভবত, তাদের কারো কাছে কিছু থাকতে পারে। ওরা তাদের নিকট গেল এবং বলল, হে যাত্রীদল! আমাদের সরদারকে বিচ্ছু দংশন করেছে, আমরা সব রকমের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই উপকার হচ্ছে না। তোমাদের কারো কাছে কিছু আছে কি? তাদের (সাহাবীদের) একজন বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম আমি একজন রাক্বী আমরা তোমাদের মেহমানদারী কামনা করেছিলাম, কিন্তু তোমরা আমাদের জন্য মেহমানদারী করনি। কাজেই আমি তোমাদের রুকইয়াহ করব না, যে পর্যন্ত না তোমরা আমাদের জন্য পারিশ্রমিক নির্ধারণ কর। তখন তারা এক পাল বকরীর শর্তে তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হল। তারপর তিনি গিয়ে (الْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ) ‘‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’’ (সূরা ফাতিহা) পড়ে তার উপর ফুঁ দিতে লাগলেন। ফলে সে (এমনভাবে নিরাময় হল) যেন বন্ধন হতে মুক্ত হল এবং সে এমনভাবে চলতে ফিরতে লাগল যেন তার কোন কষ্টই ছিল না। (বর্ণনাকারী বলেন,) তারপর তারা তাদের স্বীকৃত পারিশ্রমিক পুরোপুরি দিয়ে দিল। সাহাবীদের কেউ কেউ বলেন, এগুলো বণ্টন কর। কিন্তু যিনি রুকইয়াহ করেছিলেন তিনি বললেন এটা করব না, যে পর্যন্ত না আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট গিয়ে তাঁকে এই ঘটনা জানাই এবং লক্ষ্য করি তিনি আমাদের কী নির্দেশ দেন। তারা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে এসে ঘটনা বর্ণনা করলেন। তিনি [নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ] বলেন, তুমি কিভাবে জানলে যে, সূরা ফাতিহা একটি রুকইয়াহ? তারপর বলেন, তোমরা ঠিকই করেছ। বণ্টন কর এবং তোমাদের সাথে আমার জন্যও একটা অংশ রাখ। এ বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন।
(সহীহ মুসলিম ৩৯/২৩, হাঃ ২২০১, আহমাদ ১১৩৯৯)

রাসূল ﷺ
‏”‏ وَمَا يُدْرِيكَ أَنَّهَا رُقْيَةٌ”
এই কথা বলে উক্ত সাহাবীর সূরা ফাতিহা পাঠ করে রুকইয়াহ করাকে সমর্থন করেছেন। আর
قَدْ أَصَبْتُمْ اقْسِمُوا وَاضْرِبُوا لِي مَعَكُمْ سَهْمًا فَضَحِكَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم
এই কথা বলে রুকইয়াহ করে পারিশ্রমিক গ্রহণ করাকেও হালাল করেছেন। এতক্ষণ আমরা রুকইয়াহ সম্পর্কে রাসূল ﷺ এর কওলী, ফে’লী এবং তাক্বরীরি হাদিসগুলো উল্লেখ করলাম। সুতরাং শরয়ী রুকইয়ার হুকুম যে সুন্নাহ তা আশা করি আপনাদের নিকট দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন।